উন্নয়নের ডামাডোলের মধ্যেও দুর্ভোগ যেন পিছু ছাড়ছে না চট্টগ্রামের ৭০ লাখ নগরবাসীর। কর্ণফুলীর নদীর তলদেশে দেশের প্রথম টানেল এবং তিন সহস্রাধিক কোটি টাকার এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণাধীন।
ইতোমধ্যে চালু হয়েছে চারটি ফ্লাইওভার। জলাবদ্ধতা নিরসনে বাস্তবায়ন হচ্ছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। কিন্তু সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, অপরিকল্পিত নগরায়ণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা, যানজট, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট, ফুটপাত বেদখলে প্রতিদিনই নগরবাসীকে পোহাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় কষ্ট।
এসব সমস্যা নিয়ে যুগান্তরের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব ছাপা হলো আজ-
চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রায় ৭০ লাখ মানুষের দুর্ভোগের প্রধান কারণ জলাবদ্ধতা। প্রতি বছর বর্ষার মৌসুম এলেই নগরবাসীর ঘুম হারাম হয়ে যায়। বাসা-বাড়ি, ব্যবসা কেন্দ্র, হাসপাতাল, আবাসিক এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে সামান্য বৃষ্টিতেই। সড়ক-মহাসড়ক, অলি-গলি পরিণত হয় অথৈ নদীতে।
পাঁচ বছর পর পর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন এলে ‘জলাবদ্ধতামুক্ত নগর উপহার দেওয়ার’ প্রতিশ্রুতিটিই প্রাধান্য পায় মেয়র প্রার্থীদের ইশতেহারে। নির্বাচন আসে নির্বাচন যায়, মেয়র আসে মেয়র যায়; কিন্তু নগরীর জলাবদ্ধতা যায় না। জলাবদ্ধতার এই দুর্ভোগ যেন চট্টগ্রামের মানুষের নিয়তি হয়েই দাঁড়িয়েছে। সবার একটিই প্রশ্নআর কতকাল দেখতে হবে এই ভয়াবহ জলাবদ্ধতা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন মেয়রের আমলে ১৪ বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে খাল খননে ৩২৪ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু নিরসন হয়নি জলাবদ্ধতা।
এক দশকে কেবল জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রামে ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, চট্টগ্রাম খাল-নালা পুকুর জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, পানি নিষ্কাশনের পথ দখল করে স্থাপনা নির্মাণ, পলিথিন বর্জ্যরে ব্যাপক ব্যবহার, কর্ণফুলী নদী দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়া, সর্বোপরি অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে চট্টগ্রাম নগরী জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে।
এদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসনে ১১ হাজার কোটি টাকার চারটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
প্রকল্প মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার কামরুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সংকট নিরসনের বিষয়টি সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। এ কারণে গ্রহণ করা হয়েছে মেগা প্রকল্প। যা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন চলছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নগরীর জলাবদ্ধতা বহুলাংশেই নিরসন হবে বলে মনে করছেন তিনি।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ যেভাবে বাড়ছে তাতে তিনি চিন্তিত। নগরীতে বিদ্যমান ৫৭ টি খালের মধ্যে চউকের প্রকল্পে ৩৬ টি খাল খনন করা হচ্ছে। আরও ২১ টি খাল এর বাইরে রয়েছে। যেগুলো উদ্ধার বা খননের তালিকায় নেই। এ কারণে জলাবদ্ধতামুক্ত নগরী কখন প্রতিষ্ঠিত হবে তা নিয়ে তার যত দুশ্চিন্তা। তা ছাড়া প্রকল্প মেয়াদও বারবার বাড়ছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিগত তিন মেয়র হিসাবে ছিলেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মনজুর আলম ও আ জ ম নাছির উদ্দীন। তিন মেয়রেরই নির্বাচনি ইশতেহারে এক নম্বর প্রতিশ্র“তি ছিল চট্টগ্রাম নগরীকে জলাবদ্ধতা মুক্ত করা। এ লক্ষ্যে ক্ষমতায় এসে তারা চাক্তাই খাল খননসহ বিভিন্ন খাল খননে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থও খরচ করেছেন।
তিন মেয়রের আমলে ১৪ বছরে খাল খনন খাতেই ৩২৪ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। প্রকৌশল বিভাগের এক হিসাবে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের দুঃখখ্যাত চাক্তাই খালসহ নগরীর শাখা-প্রশাখা ও খাল খননে ৩২৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
জলাবদ্ধতার কারণ : ২০০৬-০৭ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) সর্বশেষ একটি জরিপ পরিচালনা করে। সংস্থাটির জরিপমতে গত ৩৪ বছরে হারিয়ে গেছে প্রায় ১৮ হাজার জলাধার। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী নগরীতে বর্তমানে মাত্র চার হাজার ৫২৩টি জলাধার রয়েছে।
অন্যদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ৪০ বছর আগে ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজার পুকুর, দীঘি ও জলাশয় ছিল। ১৯৯১ সালে তা দুই হাজারে নেমে আসে। এর পর পুকর জলাশয় বা জলাধার নিয়ে আর কোনো জরিপ করেনি কোনো সংস্থা।
চট্টগ্রাম খাল ও নদী রক্ষা আন্দোলনের নেতা আলীউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ১৯৬৮ সালের ‘চট্টগ্রাম বন্যা নিয়ন্ত্রণ মহাপরিকল্পনা’য় নগরীতে ৭১টি খাল চিহ্নিত ছিল। চিহ্নিত ছিল এসব খালের দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও গভীরতা। এর মধ্য থেকে অন্তত ৩৫ টি খালের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। যেসব খাল আছে সেগুলোও কোথাও সরু, কোথাও ভরাট হয়ে গেছে।
এ ছাড়া খাল-নালা দখল করে প্রতিনিয়ত নগরীতে উঠছে দালানকোঠা বা স্থাপনা। চলছে অপরিকল্পিত নগরায়ন। এতে পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। জলাবদ্ধতার এ সমস্যা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। একার কারণেও নয়। বহু বছরের পুঞ্জীভূত সমস্যার ফসল চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক ভয়াবহ জলাবদ্ধতা।
আড়াই হাজার কোটি টাকা ক্ষতি : গত এক দশকে জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম চেম্বারের সহায়তায় পরিকল্পনা কমিশনের ন্যাশনাল রিলিজিয়াস প্রোগ্রাম (এনআরপি) ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত জরিপে এই চিত্র উঠে আসে।
বিশেষ করে চট্টগ্রামের বৃহৎ ব্যবসা কেন্দ্র খাতুনগঞ্জ-চাক্তাই-কোরবানিগঞ্জের ব্যবসার ক্ষতি নিরূপণ করে জরিপ করা হয়। এতে বলা হয়, এই তিন ব্যবসা কেন্দ্রের ৫ হাজার প্রতিষ্ঠান জলাবদ্ধতায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম যুগান্তরকে বলেন, পরিচালিত জরিপে ব্যবসায়িক ক্ষতির চিত্র উঠে এসেছে। পুরো শহরে এই ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি।
চট্টগ্রামের দুঃখ চাক্তাই খাল : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে বিগত তিন মেয়রের আমল অর্থাৎ ১৪ বছরে যে ৩২৪ কোটি টাকা খরচ করেছে এর সিংহভাগ খরচ হয়েছে নগরীর পানি নিষ্কাশনের অন্যতম প্রধান খাল চাক্তাই খাল খননে। প্রকৌশল বিভাগ জানায়, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকার সময় চাক্তাই খালের তলা পাকা করা হয়।
কয়েক বছর পর এসে দেখা গেছে, পাহাড়ের বালু-মাটি ও পলিথিন ও আবর্জনা জমে এই খাল আবার ভরাট হয়ে যায়। খালের গভীরতা কমে ৩ থেকে ৪ ফুটে দাঁড়ায়। অথচ ১৫-২০ বছর আগেও এই খাল দিয়ে চলত পণ্যবাহী নৌকা। ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালের সর্বনিম্ন ২০ ফুট থেকে সর্বোচ্চ ৭০ ফুট প্রশস্ততা পর্যন্ত রয়েছে। কোথাও কোথাও বেদখল হয়ে যাওয়ার কারণে সব জায়গায় একই রকম নেই প্রশস্ততা।
অন্তত ৪৮ জন অবৈধ দখলদার খালের বিভিন্ন স্থানে দখল গড়ে তুলেছে বলে জেলা প্রশাসন চিহ্নিত করে। এভাবে কেবল চাক্তাই খাল নয় নগরীর অন্যান্য খালও দখল করেছে ভূমিদস্যুরা। যার খেসারত দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
১১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প : চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার চারটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে চউক বাস্তবায়ন করছে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম শহরের খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্প এবং ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প’।
১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন করছে ১ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন খাল খনন প্রকল্প।
চউকের ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আছে সনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ছিল এ প্রকল্পের মেয়াদ। নির্দিষ্ট মেয়াদে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ দুই দফায় বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে।
এ প্রকল্পের আওতায় চাক্তাই খালসহ বিভিন্ন খালের মুখে চলছে স্লুইস গেট বা জলকপাট নির্মাণ, ১৭৬ কিলোমিটার প্রতিরোধ দেওয়াল নির্মাণ, খালের দুই পাড়ে ৮৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ, ৪২টি সিলট্র্যাপার (পাহাড়ি বালু আটকানোর ফাঁদ) নির্মাণ, ৫৪টি ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে অর্থ সংকট, জলাবদ্ধতা, করোনা মহামারিসহ নানা কারণে এ প্রকল্পের গতি শ্লথ ছিল এতদিন।
সূত্র জানায়, ১১ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকালীন চলতি বর্ষা মৌসুমেও কয়েক দফা তলিয়ে যায় নগরী। আবাসিক এলাকা হাসপাতাল সড়ক মহাসড়কে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগের ভয়াবহতায় হাঁসফাঁস করতে থাকে নগরবাসী। প্রশ্ন তোলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের হাজার হাজার কোটি টাকার সদ্ব্যবহার হচ্ছে তো।
চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের চেয়ারম্যান ও এক সময়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে থাকা ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন (বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী) জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অর্থের সদ্ব্যবহারে সরকারকে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করার জন্য দাবি জানিয়ে আসছিলেন। চট্টগ্রামের সুশীল সমাজ এবং নগর পরিকল্পনাবিদরাও এ দাবিতে সোচ্চার ছিলেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কামরুল হাসানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি তিনটি সংস্থার ১১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন ও এর অগ্রগতির বিষয়টি মনিটরিং করছে।
কমিটির সদস্যদের প্রতিমাসে একবার প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে সভা করতে কথা বলা হয়েছে। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের নির্দেশে ২৬ জুন এ কমিটি গঠন করা হয়। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত সভায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, বড় প্রকল্পে একবার ভুল হলে তা সংশোধন করা কঠিন। তাই কমিটিকে বলা হয়েছিল বাস্তবায়নকালীন কোনো ত্র“টি বা ভুল ধরা পড়লে তা সংশোধনের ব্যবস্থা নেওয়ার।
কমিটির প্রধান চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কামরুল হাসান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি কমিটির সদস্যদের নিয়ে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছি। কাজের অগ্রগতি দেখভাল করছি। কোথাও কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে বা বাধা এলে তা দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করছি। তবে কোন প্রকল্পের কাজ কত শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জানাতে পারেননি। ’
চট্টগ্রামের নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি আশিক ইমরান যুগান্তরকে বলেন, ‘জলাবদ্ধতার বহু দিনের এ সমস্যা একদিনে সমাধান করা সম্ভব নয়। যেসব প্রকল্প সরকার গ্রহণ করেছে সরকার তার সঠিক বাস্তবায়ন হলে নগরী বহুলাংশে জলাবদ্ধতামুক্ত হবে, এটা আশা করা যায়।’